বৃহস্পতিবার ১২ জুন ২০২৫, ২৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
প্রকাশিত: ২০২৫-০৫-১৬ ২৩:৩৮:২৫
আজ ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস।
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ের পর ব্রিটিশরা ব্যপকভাবে এই অঞ্চলে ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসার ঘটায় এবং বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে কোলকাতা বন্দর গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে। বিশেষ করে বাংলা থেকে কাঁচামাল রপ্তানি করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ পথ হিসেবে এই বন্দর ব্যবহৃত হতে থাকে। আর এই কোলকাতা বন্দর ভাগিরথী এবং হুগলি নদীর তীরে গোড়ে উঠায় এবং দুই নদীর নাব্যতা সংকটের কারণে ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং কোলকাতা বন্দরের নাব্যতা ধরে রাখার জন্য ১৮৫১-১৯৪৫ পর্যন্ত ৫টি সমীক্ষা চালিয়েছে যাতে গঙ্গার পানি দিয়ে ভাগিরথী হুগলি নদীর নাব্যতা সংকট ফিরিয়ে আনা যায় এবং কোলকাতা বন্দরে কোনো প্রভাব না পড়ে।
নানা কারণে সে প্রকল্প বাস্তবায়ন না হলেও ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর আবার তা নতুন করে আলোচনায় আনেন পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধানচন্দ্র রায়। তিনি ১৯৪৮ সাল্র মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ১৯৫১ সাল থেকেই ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকার কে ফারাক্কা বাধ নির্মাণের জন্য বারবার চিঠি দিতে থাকেন। কিন্ত কেন্দ্রীয় সরকার তার এই দাবীকে বারবার অগ্রাহ্য করলেও তিনি তার দাবী থেকে সরে আসেন নি।
অবশেষে কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৬১ সালে এই প্রকল্প গ্রহণ করে এবং নির্মাণ কাজ শুরু করে। বিধানচদ্রের আমলেই নির্মাণ কাজ শুরু হলেও তার মৃত্যুর ১৩ বছর পর অর্থাৎ ১৯৭৫ সালে নির্মাণ কাজ শেষ হয় এবং ৭৫ সালের ২১ এপ্রিল সাময়িক সময়ের জন্য ফারাক্কা বাধ চালু করা হলেও ৫১ বছরেও তা আজও বন্ধ হয়নি।বাংলাদেশে ফারাক্কার সুদূরপ্রসারী প্রভাব নিয়ে অনেকেই কথা বললেও কাওকে তেমন সেরকম ভূমিকা গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। দেশের জনগণের প্রতি ভালোবাসা এবং দায়বদ্ধতা থেকে প্রথম আন্দোলন শুরু করেন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। ৯৬ বছর বয়সে মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে অসুস্থ শরীরে আনদোলনের নেতৃত্ব দেন জনগণ কে উদ্বুদ্ধ করেন। তাঁর এই আন্দোলন দেশ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পায়। কিন্ত ভারত সরকার একতরফা ভাবে পানি প্রত্যাহার করতেই থাকে। এর প্রভাবে দেশের গঙ্গা-পদ্মার প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার নৌপথ অকার্যকর হয়ে পড়েছে এবং লবণাক্ততার কারণে খুলনা অঞ্চলে ধান উৎপাদন কমে গেছে ও সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে।
এছাড়াও দেশের এক তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ৬ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। রাজশাহী অঞ্চলে নিরাপদ সুপেয় পানির অভাব। ক্ষরা, ভূ-গর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের মারাত্মক উপস্থিতি,ভূ-গর্ভস্থ পানি নিচে নেমে যাওয়া সাধারণ ঘটনা। আন্তর্জাতিক নদী আইন অনুযায়ী যা ১৯৯৭ সালের ২১মে জাতিসংঘের সভায় Convention হিসেবে গ্রহণ করা হয় এবং আইন অনুযায়ী -Equitable and Reasonable Utilization এবং No Significant Harm আন্তর্জাতিক জলনীতির মূলভিত্তি। নীতিগুলোর বিপরীতে ৫১ বছর ধরে ভারত একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে যাচ্ছে যা স্পষ্টত আন্তর্জাতিক নদী আইনের লঙ্ঘন।
আন্তর্জাতিক নদী আইন থাকার পরেও এবং বাংলাদেশ সেই আইনের মাধ্যমে আশ্রয় লাভ করার সুযোগ থাকলেও কোনো এক অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে বাংলাদেশ আজও সেই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। ভারতীয় পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। ১৯৯৩ সালের ১অক্টোবর জাতিসংঘের ৪৮তম অধিবেশনে ফারাক্কা ইস্যু নিয়ে দৃড় মনোভাব প্রকাশ করেন এবং ভারতীয় প্রতিনিধিরা অবাক হয়ে যায়। তার এই বক্তব্য বিশ্ব সভ্যতা ও বিশ্ব বিবেকের দরজায় সজোরে করাঘাত করলেও তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী তীব্র সমালোচনা করে।
পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে আওয়ামিলীগ ক্ষমতায় আসার পর ৯৬ এর ১২ ডিসেম্বর ভারতের সাথে ফারাক্কা চুক্তি হলেও সেই, চুক্তির কতটুকু প্রতিফলন ঘটেছে এবং বাংলাদেশ নাহ্য হিস্যা পাচ্ছে কিনা তা নিয়ে তীব্র সমালোচনা আছে।দেশের প্রাণ প্রকৃতি আজ হুমকীর মুখে, অনেক নদী আজ স্বাভাবিক নদীপ্রবাহ হারিয়ে বিলীন হওয়ার পথে,বদীকে কেন্দ্র করে কোটি কোটি কৃষকের আশা স্বপ্ন আজ ধ্বংসের পথে,দেশে পানির হাহাকার এবং সুপেয় পানির ঘাটতির কারনে আর্সেনিক,ডায়রিয়া থেকে শুরু করে স্বল্প এবং দীর্ঘ মেয়াদী নানা রোগে ভুগছে।
তাই সরকারের উচিত ভারতের সাথে শক্তিশালী কূটনীতিক উদ্যোগ গ্রহণ করা অথবা ১৯৯৭ সালে আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহ কনভেনশনটি ২০১৪ সালের ১৭ আগস্ট থেকে আইনে পরিণত হয়েছে। সেখানে উজানের দেশ থেকে ভাটির দেশে প্রবাহিত নদীর পানি কীভাবে ব্যবহূত হবে, তার দিকনির্দেশনা আছে।যে নদীর পানি যে খাতে প্রবাহিত হয়, সেই নদীর পানি সেই খাতে না রেখে খাত পরিবর্তন করলে তা নদীর জন্য কল্যাণের হবে না।তাই উক্ত আন্তর্জাতিক এই আইনে স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ নদীর পানির নাহ্য হিস্যার দাবী করার অধিকার রাখে।