টুম্পা: ট্রাজেডির রাজকন্যা
টুম্পা: ট্রাজেডির রাজকন্যা
চলে গেছেন ১৩ বছর দু'মাস আগে। মাত্র ২২ বছরের প্রস্ফুটিত তরতাজা তরুণী! কী ছিল তাঁর মাঝে? কেন তার প্রয়াণে কেঁদেছে পুরো চট্টগ্রাম তথা দেশ! অজানা সে মর্মন্তুদ শোক কাহন সংক্ষেপে খুঁড়ে আনার চেষ্টা করছি। তিনি চট্টল কিংবদন্তি চট্টগ্রামের প্রথম নির্বাচিত ও টানা তিনবারের সফল সিটি মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সবচেয়ে 'প্রিয় কন্যা' ফৌজিয়া সুলতানা টুম্পা। লেখায় আবেগ ও মাত্রা বিড়ম্বনা থাকবে- শুরুতেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
মোস্তফা কামাল পাশাচলে গেছেন ১৩ বছর দু'মাস আগে। মাত্র ২২ বছরের প্রস্ফুটিত তরতাজা তরুণী! কী ছিল তাঁর মাঝে? কেন তার প্রয়াণে কেঁদেছে পুরো চট্টগ্রাম তথা দেশ! অজানা সে মর্মন্তুদ শোক কাহন সংক্ষেপে খুঁড়ে আনার চেষ্টা করছি। তিনি চট্টল কিংবদন্তি চট্টগ্রামের প্রথম নির্বাচিত ও টানা তিনবারের সফল সিটি মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সবচেয়ে 'প্রিয় কন্যা' ফৌজিয়া সুলতানা টুম্পা। লেখায় আবেগ ও মাত্রা বিড়ম্বনা থাকবে- শুরুতেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
এপিটাফ-১: "বাপের সাথে প্রাণ খুলে খুনসুটি করো টুম্পা! বাপ মহিউদ্দিন চৌধুরীর প্রাণভোমরা, কলজের টুকরোও তুমি! চশমা মসজিদ পারিবারিক গোরস্তানে মাত্র সাড়ে পাঁচ ফুট মাটির নিচে দু'জন শুয়ে আছো কাছাকাছি! একই সমান্তরালে গর্ভধারিণী মা শাহেদা মহিউদ্দিন, দাদা,দিদাও! সব ব্যস্ততা শেষ, বাপ-বেটির। ইচ্ছেমত আড্ডা দাও-যতখুশি। কেউ বিরক্ত করবে না- একদম। জানবেও না! তোমাদের কানাকানির তরঙ্গ মোবাইল নেটওয়ার্কের আওতার বাইরে! আপনরাও জানবে না, কাছে থেকেও!
জান টুম্পা, তোমার বড় ভাই নওফেল এখন উপমন্ত্রী! তোমার আব্বুর সম্মানে প্রিয় নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আস্থার একজনও। বিশ্বাস হয় তোমার? তোমরাতো পিঠাপিঠি ভাই-বোন। তুমিতো পবিত্র, অপাপবিদ্ধ, ওর জন্য আল্লাহকে বলো, যাতে প্রিয় নেত্রীর আস্থার মর্যাদা এবং তোমার আব্বুর মানবিকতার ঝর্ণাধারায় নাইতে সর্বোচ্চ চেষ্টাটা চালায়। তুমিতো বাপকে খুব কম কাছে পেয়েছো। চলে যাবার সময়ও না! এখনতো কাছে আছে-সবসময়! খুউব মজা না-মেয়ে! ভাল থাকো বাপ-বেটি! তোমাদের ভাল ছবি নেই, তাই স্মারক প্রকাশনা থেকে জুড়ে দিলাম! এ্যন্জেলদের বলো রাগ না করতে! শাস্তি যেন আমার জন্য তুলে রাখে!
*** "টুম্পারা সেলিব্রিটি তারকা হতে আসে না, তারা বহুমুখী প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটায় মানুষের ভেতরকার জমাট আঁধার খোড়লে। মানুষ চমকে যায়-অবাক হয়! ভাবে, আরে এতো আলো নয়, নিখুঁত কাট হীরের দ্যূতি! টুম্পারা এমনই ক্ষণজন্মা তারকা, যারা অমর-অক্ষয়- চিরন্জীব! এদের মুছে ফেলা যায় না, মুছতে গেলেই আরো বেশি দ্যূতি ছড়ায়-জ্যোতির্ময় হয়ে উঠে"!
* চট্টল অহং-গণ মানুষের প্রিয় নেতা, সফল মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর জেষ্ঠ ও প্রিয় কন্যা ফৌজিয়া সুলতানা টুম্পাকে নিয়ে দু'টো স্মারকগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে (বাংলা ও ইংরেজি) দু'ভাষায়। প্রিয় নেতা মহিউদ্দিন চৌধুরীর প্রবল আগ্রহে। উপরের দ্বিতীয় উদ্ধৃতি দ্বিতীয় প্রকাশনার সম্পাদকীয় কলামের শেষাংশ। সৌভাগ্য কী দূর্ভাগ্য জানিনা, দু'টো কাজের সম্পাদনাই এই আর্বাচিনকে করতে হয়েছে। এতো এতো গুণী থাকতে কোন খেয়ালের টানে তিনি এমনটি করেছেন? প্রশ্নটা এখনো বিষ কাঁটার হুল হয়ে বিঁধে আছে-থাকবেই।
দ্বিতীয় প্রকাশনা ২০১৬ সালে প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি ডেল (Department of English Language & Literatur) এ্যালামনাই সোসাইটির ব্যানারে।
প্রথমটি প্রকাশ হয়, টুম্পা স্মরণ পরিষদ-চট্টগ্রাম ব্যানারে-২০০৯ এ, টুম্পার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে। পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন প্রয়াত বিশ্বখ্যাত ভৌত পদার্থবিজ্ঞানী ড.জামাল নজরুল ইসলাম, সদস্য সচিব আমি।
প্রথম প্রকাশনা অনুষ্ঠান হয় ইন্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট চট্টগ্রাম কেন্দ্র মিলনায়তনে। আয়োজনে লন্ডন থেকে বরেণ্য সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরীকে উড়িয়ে আনা হয়। দেশের সর্বস্তরের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরাও ছিলেন। পরদিন একই ভেন্যুতে হয় আলিশান জেয়াফত। সব টুম্পার আব্বুর উদ্যোগে। চিঠিপত্র আমাদের নামে বিলি হলেও মধ্যমনি ছিলেন মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী।
দ্বিতীয়টার প্রকাশনা উৎসব হয় প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির জিইসি'র নতুন প্রধান ক্যাম্পাস মিলনায়তনে। কৃতি সাহিত্যিক, অধ্যাপক সৈয়দ মন্জুরুল ইসলাম, অধ্যাপক মোহিত উল আলমসহ বরেণ্য ব্যাক্তিত্ব, শিক্ষাবিদরা অংশ নেন। অজ্ঞাত কারণে গ্রন্থ প্রকাশের মূল অনুঘটক মহিউদ্দিন চৌধুরীও আয়োজনে ছিলেন না! নিজেও আমন্ত্রণ পাইনি।
ফেরা যাক টুম্পা প্রসঙ্গে। ঘাতক ক্যান্সার মাত্র ২২ বছরের ঝকঝকে তরুণী টুম্পাকে কেড়ে নেয় প্রিয় বাবা মহিউদ্দিন চৌধুরীর বুক থেকে! তখন ফৌজিয়া প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ৬ষ্ট সেমিষ্টারের সবচেয়ে উজ্জ্বল মুখ। শুধু ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে না, আবৃত্তি, গান, বই পড়া, অভিনয়, বিতর্ক, আঁকা, লেখালেখিসহ সব সৃজনশীল ও দাতব্য কাজে টুম্পা ছিলেন সবার আগে।
জনকের জনপ্রিয়তার বলয় ভেঙে টুম্পা নিজেই তৈরি করেন সৃজন-মননের আলাদা বলয়। ছিপছিপে দীঘল, প্রিয়দর্শিনী টুম্পা মধুর ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের দীপ্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকসহ পরিচিত সবাইকে দ্রুত জয় করে নেন। গড়ে তোলেন ডেল সাংস্কৃতিক ও ড্রামা ক্লাবসহ বহু সংগঠন।
একবার যিনি কাছে এসেছেন, কখনো ভুলতে পারবেন না টুম্পাকে। কম সুবিধাসম্পন্ন ছাত্র ছাত্রীদের স্টুডেন্টশিপের ব্যবস্থা করে দিতেন নিজ উদ্যোগে। পরিবারে বাবাসহ সবার আদরের ধন টুম্পা। টুম্পার মানবপ্রেম ছিল বিস্ময়কর!
তিনি গোপনে রিক্সা, ভ্যানচালকসহ অনেক গরীব মানুষকে নিজের হাত খরচের টাকায় স্বাবলম্বী করেছেন। কাক পক্ষিও তাঁর মানবব্রতের খবর জানত না। ভোগবাদী প্লাবনের নষ্ট সময়ে এত কম বয়সী তরুণীটি কীভাবে বিরল গুণটি অর্জন করেছেন, ভাবতেই অবাক লাগে! সৌভাগ্য, তাঁকে নিয়ে কাজ করতে গিয়ে এমন দুটো চরিত্রের খোঁজ পেয়ে যাই, কঠিন শর্ত মেনে তাদের সাথে কথা বলতে হয়।
দূর্ভাগ্য, ঘাতক ক্যান্সার বেছে নিল কিনা তাঁকে। জনক এক/এগারোর অস্বাভাবিক সরকারের কারাগারে বন্দী থাকাকালীন টুম্পা ক্যান্সার আক্রান্ত হন। পরে তাঁকে ব্যাঙ্কক পিয়াথাই-২ বিশেষায়িত হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, ভগ্নিপতি ডা. সেলিম আকতার চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে। ওখানেই ১৭ অক্টোবর ২০০৮ সালে টুম্পা চিরবিদায় নেন। মৃত্যুর আগে বাবা-মেয়ের শেষ দেখা হয়নি।
মাত্র ক'দিন আগে মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী মুক্তি পান। কিন্তু সরকার তাঁকে দেশ ছাড়ার অনুমতি দিতে ভয় পায়। শেষ মুহূর্তে অনুমতি মিললেও বিমানবন্দরই তিনি প্রিয় কন্যার শেষ বিদায়ের খবর পান। তবুও অঝোর নোনাজলে সাঁতরে অসুস্থ মেয়র সস্ত্রীক উড়ে যান ব্যঙ্কক-মেয়ের লাশ আনতে। লাশ ফিরে আসলে চট্টগ্রামে স্মরণকালের বৃহত্তর জমায়েত ঘটে, মাত্র ২২ বছরের মেয়েটির জানাজায়! গণমানুষের অবিশ্বাস্য এক সমুদ্র!
মহিউদ্দিন চৌধুরীর প্রাণভোমরা ছিলেন টুম্পা। তাঁর নাম উচ্চারিত হলেই বাঘের চেয়েও সাহসী মানুষটি অঝোর কান্নায় ভেঙে পড়তেন।
কারাগারে থাকতে টুম্পা জনককে একটি চিঠি লিখেন। চমৎকার ইংরেজিতে লেখা চিঠিটি যেমন আবেগে ঠাঁসা,তেমনি পিতার প্রতি মমত্ব, গর্ব, বেদনার সম্মিলনে এক অমর সৃষ্টিও বটে! বেঁচে থাকতে মহিউদ্দিন চৌধুরী বারবার এই চিঠি পড়ে কান্নার নোনায় ভেসে যেতেন। আশপাশের সবাইকেও কাঁদাতেন।
যদিও অনেক সত্য আড়ালেই রাখতে হয়। অপ্রিয় সত্য, কিছু স্মৃতি মানুষ জোর করে মুছে ফেলতে চায়। স্মৃতিগুলো সুখের নয় ক্ষতের-যন্ত্রণার! নিজের তৈরি হলেতো স্মৃতির কষ্ট একদম দুঃসহ ও ভয়াবহ! যতবেশি মুছতে যাবেন ততবেশি দগদগে ঘা হয়ে ভেসে উঠবে-পোড়াবে! নিজের জীবন ও অভিজ্ঞতার ঝুলিতে এমন কিছু স্মৃতি ইচ্ছার বিরুদ্ধে জবরদস্তি ঢুকে আছে। এগুলো কখনো বের করা যাবে না-অসম্ভব!
লেখক- মোস্তফা কামাল পাশা, সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
বাংলাদেশ জার্নাল/এমজে
from BD-JOURNAL https://www.bd-journal.com/other/184258/টুম্পা-ট্রাজেডির-রাজকন্যা