‘বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ’ আইনের স্পষ্ট অপব্যহার, হয়রানির শেষ কোথায়?

‘বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ’ আইনের স্পষ্ট অপব্যহার, হয়রানির শেষ কোথায়?

‘বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ’ আইনের স্পষ্ট অপব্যহার, হয়রানির শেষ কোথায়?

বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের বিষয়টি নিয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে যেতে হলে আমাদের শুরুতেই দেখতে হবে ধর্ষণের সংজ্ঞা।

আর আই শাহরিয়ার

বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের বিষয়টি নিয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে যেতে হলে আমাদের শুরুতেই দেখতে হবে ধর্ষণের সংজ্ঞা। কারণ, এখানে ধর্ষণকে প্রধান অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, এবং ধর্ষণের ক্ষেত্রে অভিযোগকারী নিরসম্মতি আদায় করা হয়েছে বিয়ের প্রলোভনে। অর্থাৎ, বিয়ের প্রলোভন এখানে সম্মতি আদায়ের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক।

দন্ডবিধি ১৮৬০ এর ৩৭৫ ধারায় ‘ধর্ষণ’কে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। এই ধারা অনুযায়ী পাঁচটি অবস্থায় যৌন সম্পর্ক স্থাপন করলে তা ধর্ষণ হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে,

১। নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে।

২। নারীর সম্মতি ছাড়া।

৩। মৃত্যু কিংবা জখমের ভয় দেখিয়ে নারীর সম্মতি নিয়ে।

৪। নারীর সম্মতি নিয়েই। কিন্তু পুরুষটি জানে যে সে ঐ নারীর স্বামী নয় এবং ঐ নারীটি তাকে এমন একজন পুরুষ বলে ভুল করেছে যে পুরুষটির সাথে তার আইন সঙ্গতভাবে বিয়ে হয়েছে বা বিবাহিত বলে সে বিশ্বাস করে।

৫। নারীর সম্মতিসহ বা সম্মতি ছাড়া যদি সে- নারীর বয়স ১৬ বছরের কম হয়। এখন, বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের বিষয়টি বিশ্লেষণে দেখা যায়, সেখানে অভিযুক্ত ব্যক্তি বিয়ের প্রলোভনে নারীর সম্মতি আদায় করেছে যা ৩৭৫ ধারায় ধর্ষণের শর্তের অন্তভুক্ত না। ফলত, ৩৭৫ ধারায় প্রদত্ত সংজ্ঞার সরল বিশ্লেষণে স্পষ্টত যে, বিয়ের প্রলোভনে যৌন সম্পর্ক স্থাপন ধর্ষণ হিসেবে সংজ্ঞায়িত হবে না।

অন্যদিকে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ২ (ঙ) ধারায় বলা হয়েছে, ‘ধর্ষণ’ অর্থ ধারা ৯ এর বিধান সাপেক্ষে, Penal Code, ১৮৬০ (Act XLV of ১৮৬০) এর Section ৩৭৫ এ সংজ্ঞায়িত ‘rape’, অর্থাৎ, দণ্ডবিধি, ১৮৬০ এর ৩৭৫ ধারায় প্রদত্ত ধর্ষণের সংজ্ঞা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ক্ষেত্রে ও প্রযোজ্য।

বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ:

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ৯ (১) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোন পুরুষ কোন নারী বাশিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহলে তিনি যাবজ্জীবন শ্রমকারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থ দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।

ব্যাখ্যা—যদি কোন পুরুষ বিবাহ বন্ধন ছাড়া ষোল বছরের অধিক বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতি ছাড়া বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণা মূলকভাবে তার সম্মতি আদায় করে অথবা ষোল বছরের কম বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ছাড়া যৌন সঙ্গম করে তাহলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করেছেন বলে গণ্য হবে।

এই ধারা ও সম্মতি নিয়ে দৈহিক সম্পর্ক হলে তা অপরাধ হিসেবে গন্য হবে না তবে বয়স হতে হবে ষোলো বছরের বেশি। তবে ব্যাখ্যা অংশের একটি বিষয় এখানে উল্লেখ্য, বলা হয়েছে—প্রতারণা মূলকভাবে যদি সম্মতি আদায় করা হয়। বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের অভিযোগ মূলত এই বিধানের বিপরীতে দায়ের করা হয়।

তবে এক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন মনে আসতেই পারে যে, বিয়ের প্রলোভনে সম্মতি আদায় কোনো বৈধ চুক্তি হতে পারে কি না? সেক্ষেত্রে ধর্ষণ না হয়ে চুক্তি ভংঙ্গের মামলা দায়েরের কোনো সুযোগ রয়েছে কি না? আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে আপাতত না।কারণ, মুসলিম শরীয়াহ  আইনের বিধানানুযায়ী, ভবিষ্যতে বিবাহের প্রতিশ্রুতি সংক্রান্ত কোনো মৌখিক চুক্তি অনুমোদিত না। উপরন্তু, বিবাহের চুক্তি সর্বদা লিখিত ও নিবন্ধিত হতে হবে। তথাপি, চুক্তি আইন ১৮৭২ এর ২ (জ) ধারানুযায়ী, যে কোনো সম্মতি বা কোনো বিষয়ে কথা দিলেই তা চুক্তিতে রূপান্তর হয় না যত ক্ষণ না পর্যন্ত সম্মতিটি আইন দ্বারা বলবৎ যোগ্য হয়।

প্রক্ষান্তরে, বিয়ের প্রলোভনে সম্মতি আদায় প্রতারণা হতে পারে কি না? যদি হয়, তবে সেক্ষেত্রে আইনে এটার আলাদা ব্যাখ্যা এবং আলাদা শাস্তির বিধান থাকা উচিত।

অন্যদিকে, দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ৪৯৩ ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি যদি কোনো নারীকে প্রতারণা মূলকভাবে আইন সম্মত বিবাহিত বলে বিশ্বাস করান, কিন্তু আদৌও বিয়ে আইন সম্মতভাবে না হয় এবং ওই নারীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেন, তবে অপরাধী সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত সশ্রম বা বিনা শ্রম কারাদণ্ডে ও অর্থ দণ্ডে দণ্ডিত হবে।

এই ধারাটি মূলত বিয়ে বলবৎ আছে বিশ্বাস করিয়ে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অতএব, এই ধারায় বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে বা ভবিষ্যতে বিয়ে করার আশ্বাস দিয়ে দৈহিক সম্পর্ক করলে তা অপরাধ হবে না।

উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তসমূহ : হানিফ শেখ বনাম আছিয়া বেগম [৫১ ডিএলআর, ১২৯] মামলায় মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট বলেন যে, ১৬ বছরের অধিক কোনো মেয়েকে যদি কোনো পুরুষ বিয়ের প্রলোভন দিয়ে যৌন কর্ম করে, তাহলে তা ধর্ষণ বলে গণ্য হবে না।

Kamal Hossain Vs. State, 61 DLR 505 মামলায় উচ্চ আদালত সিদ্ধান্ত প্রদান করেন যে, ‘The unfortunate mature girl mixed with appellant consciously at her own peril and this appellant though knew the fate of the victim girl, took that opportunity of free consent and mixing which does not fall within the purview of any legal action’.

ভারতীয় আদালতের সিদ্ধান্ত:

অন্যদিকে, বোম্বে হাইকোর্ট একটি মামলায় সিদ্ধান্ত প্রদান করেন যে, শিক্ষিত ও প্রাপ্ত বয়স্ক নারীদের ক্ষেত্রে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শারীরিক সম্পর্ককে ধর্ষণ হিসেবে গণ্য করা যাবে না।

আজকাল অনেকেই এধরনের মামলায় উৎসাহী হচ্ছে। ‘বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ’ এরকম অদ্ভুত ও হাস্যকর একটি বাক্য যে এবারই প্রথম সামনে এসেছে তা নয়, ক্রিকেটার রুবেলের বিরুদ্ধে চিত্রনায়িকা হ্যাপি যখন এধরনের একটি মামলা দায়ের করেছিলেন এই আইনটি তখন বিশদভাবে প্রকাশিত হয়।

সাম্প্রতি মিসেস তৃণা ইসলাম নামে এক নারী একটি প্রেস ব্রিফিংকরেছেন ও পরবর্তিতে মামলা করেছে। সেখানে তিনি অভিযোগ করেছেন ৭১ টেলিভিশন এর বার্তা প্রধান জনাব শাকিল আহমেদ বিয়ের প্রলোভনে নামে তাঁর ধর্ষণ করেছে ।

এর পরিপ্রক্ষিতে বেশ কিছু প্রশ্ন মাথায় এসেছে:

১. ডা. তৃণা চাকুরী করতেন, আইইডিসিআরএ। সরকারী চাকুরী। সরকারী চাকুরী থেকে কাউকে ডিসমিস করতেও ৪ বছর সময় লাগে। সম্পর্কটাই ৬ মাসের। জনাব শাকিল প্রভাব খাটিয়ে চাকুরি কেড়ে নিয়েছেন? নিজেই বলেছেন সকালে ফোন দিয়েছে বিকালে চাকরী নাই! আমার জানা মতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও এটা পারেন না, পারেন শুধু মহামান্য রাষ্ট্রপতি।

২. ২য় অপরাধ ভ্রুণ হত্যা। গর্ভ আপনার, হত্যা করলো শাকিল? শাকিল কি আপনার পেটে লাথি দিয়ে মিসকারেজ ঘটাইসে? অথচ সংবাদ সম্মেলনে আপনি বলেছেন কাতার এয়ারপোর্টে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে, ঢাকা এয়ারপোর্টে এসে ওষুধ খেয়েছেন। জনাব শাকিল কি তখন আপনার সাথে ছিল? তদুপরি আপনি আবার ডাক্তার।

৩. বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় চিকিৎসক মিসেস তৃণা ইসলামের দায়ের করা মামলাটির এজাহার প্রকাশিত হয়েছে। আমি সেটি দেখেছি। সেখানে তিনি বলেছেন শাকিল সাহেবের সাথে তাঁর প্রেমের সম্পর্ক ছিলো এবং তার মানে এটা পরিস্কার আপনি স্বেচ্ছায় শাকিল সাথে সম্পর্ক করেছেন আর এখন প্রমান করতে চাচ্ছেন শুধু মাত্র বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে দিনের পরদিন আপনাকে ধর্ষণ করেছে!

৪. তিনি বিবাহিত এই কথাটি কেন লুকিয়ে রেখেছিলেন সংবাদ সম্মেলনে? একজন বিবাহিত নারীতার এক্সসিস্টিং বিয়েটির সমাপ্তি না টেনে আরেকটি বিয়ের প্রলোভনে কেন পড়লেন এবং তাঁর যেই বয়স সেই বয়সে আরেকজন বিবাহিত পুরুষের বিবাহ করতে চাই বার ইচ্ছের প্রেক্ষিতে একজন চিকিৎসক হয়ে সেটিতে প্রলোভিত হওয়া যায়? এবং বাংলাদেশের আইনে একটি বিয়ে চলমান থাকা অবস্থায় আরেকটি বিয়ে করা যায় ?

আমি জানি এবং মানি আইন আর নৈতিকতা সব সময় এক সাথে মিলে যায় না। আইনগতভাবে বৈধ বিষয় যেমন অনৈতিক হতে পারে, তেমনি আইনগতভাবে অবৈধ বিষয়ও হতে পারে নৈতিক। যেমন কিছু দিন আগেই সরকার বিশেষ বিবেচনায় বিয়ের বয়স ষোলোতে অনুমোদন দিয়েছে আইনগতভাবে। অথচ সাবলকত্বের বয়স রাখা হয়েছে আঠারোই। নাবালক স্বীকার করে বিয়ের আইনটা যেমন হাস্যকর, একইভাবে কোনো প্রাপ্ত বয়স্ক নারী যদি প্রলোভনে পড়ে (বিয়ে বা অন্য কিছুর) স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে পরে সেটা না পেলে এসে ধর্ষণ মামলা করতে পারেন সেটাও আমার একই রকম হাস্যকর মনে হয়।

আমার মনে হয় এধরনের মামলার মধ্যে তিনটির যে কোনো একটি উদ্দেশ্য থাকতে পারে। প্রথমত, অভিযুক্তের নিকট হতে আর্থিক সুবিধা লাভ। দ্বিতীয়ত, সামাজিক চাপে ফেলে বিয়ের সম্ভাবনার পথ তৈরি। তৃতীয়ত, নিতান্ত প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে অভিযুক্তের সামাজিক মর্যাদা ক্ষুন্ন করা। 

লেখক: আর আই শাহরিয়ার (আইনজীবী ও খণ্ডকালীন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক)।

© Bangladesh Journal


from BD-JOURNAL https://www.bd-journal.com/other/181304/বিয়ের-প্রলোভনে-ধর্ষণ-আইনের-স্পষ্ট-অপব্যহার-হয়রানির-শেষ-কোথায়