ভারত: যেদেশে সেনা অভ্যুত্থান হয় না

ভারত: যেদেশে সেনা অভ্যুত্থান হয় না

ভারত: যেদেশে সেনা অভ্যুত্থান হয় না

অনলাইন ডেস্ক

উপনিবেশ পরবর্তী যুগে এশিয়া ও আফ্রিকার বহু দেশে সামরিক স্বৈরতন্ত্র একটা সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। স্বাধীনতা উত্তর পঞ্চাশ-ষাট দশকের ভারতেও এমন হুমকি ছিল। ১৯৬৭ সালের নির্বাচন কভার করতে এসে ব্রিটেনের টাইমস পত্রিকার সাংবাদিক নেভাইল ম্যাক্সওয়েল ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, এই নির্বাচনই হতে পারে ভারতের সর্বশেষ নির্বাচন। সেই সময়টাতে অনেকের বিশ্বাস ছিল, ভারত অচিরেই সামরিক শাসনাধীন হয়ে পড়বে। কিন্তু ভারত আজও সেনা অভ্যুত্থান প্রতিরোধ্য। এদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোর সুশৃঙ্খলতা, চমৎকার পেশাদারী মনোভাবের পাশাপাশি দেশটির রাজনীতিবিদগণের গণতান্ত্রিক সচেতনতা, ভৌগলিক বৈচিত্র্যসহ নানান রাজনৈতিক এবং সামরিক কার্যক্রম ও বৈশিষ্টকে এর কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

  ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু বিশ্বাস করতেন, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর গঠন কোনোভাবেই গণতন্ত্রের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করবে না। সদ্য স্বাধীন ভারতে নানামূখী পদক্ষেপের মাধ্যমে তিনি সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রনে আনার কার্যক্রম শুরু করেন। এরমধ্যে ঐতিহ্যগতভাবে ভারতীয় সেনাপ্রধানের বাসভবন ‘তিন মূর্তি ভবন’কে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন হিসেবে ঠিক করা, ধারাবাহিকভাবে সেনা বাজেট হ্রাসকরণ, প্রকাশ্যে সরকারের অর্থনৈতিক কর্মসূচির সমালোচনার কারণে স্বাধীন ভারত সেনাবাহিনীর প্রথম ‘কমান্ডার-ইন চিফ’ প্রয়াত ফিল্ড মার্শাল কোডান্ডেরা মাডাপ্পা কারিয়াপ্পাকে তিরস্কার করাসহ নানান পদক্ষেপে সশস্ত্রবাহিনীর প্রভাব বেশ নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে।   ১৯৫৮ সালে প্রতিবেশী পাকিস্তানে সামরিক অভ্যুত্থানের পর ভারতের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কৃষ্ণ মেননের মতন একজন ক্ষমতাধর, কর্কশ ও বামপন্থী বুদ্ধিজীবকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়ে সশস্ত্রবাহিনীকে বেসামরিক কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বের অধীনস্থ করার প্রত্রিয়া শুরু করেছিলো। পরবর্তীতে পরিবর্তিত বেসামরিক ও সামরিক কর্তৃপক্ষের ‘অর্ডার অব প্রিসিডেন্স’ বা পূর্ববর্তিতার ক্রম, সেনাবাহিনীতে পদোন্নতির দিকে ঘনিষ্ঠ নজরদারি, অবসরপ্রাপ্ত সেনাপ্রধানদের দেশে না রেখে দূরবর্তী কোনো দেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে প্রেরণসহ বিবিধ কর্মসূচির ফলে সত্তর দশকের মধ্যেই ‘চেকস এ্যান্ড ব্যালান্স’-এর সুশৃঙ্খল বলয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী একটি ‘অভ্যুত্থান প্রতিরোধী’ বাহিনী হিসেবে গড়ে ওঠে।

সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীসমূহে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বৈচিত্র্যময় সেনা সমাবেশ, সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস ও ভারসাম্য রক্ষায় নানাবিধ আধা-সামরিক বাহিনী প্রতিষ্ঠা এবং পৃথক নিয়ন্ত্রন ব্যবস্থা অভ্যুত্থান প্রতিরোধে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে ভারতীয় সামরিক বাহিনী যথা- সেনা, নৌ, এবং বিমান ও তিনটি আধা সামরিক শাখা-রাইফেলস, কোস্ট গার্ড এবং স্পেশাল ফ্রন্ট ফোর্স-এসবগুলোই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রনাধীন। ভারতের অন্যান্য আধা-সামরিক বাহিনী যথা-দেশের অভ্যন্তরীন অস্থিতিশীলতা দমন করার জন্য সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স, বিমান বন্দর এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহ রক্ষার জন্য সেন্ট্রাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিকিউরিটি ফোর্স, বিএসএফ, ইন্দো তিব্বতীয় পুলিশ, এসএসবি ইত্যাদির প্রধানরা সেনাবাহিনী থেকে স্বতন্ত্র এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়য়ের অধীন। এছাড়া প্রায় ৩০ লাখ রাজ্য পুলিশ রয়েছেন নিজ নিজ রাজ্যের দায়িত্বে।  এইসব কারণে ভারতের সব আধা সামরিক বাহিনীকে একত্রিত অত্যন্ত দুরুহ ব্যাপার।

ভারতের শক্তিশালী গণতন্ত্র এবং নিয়মিত নির্বাচন আয়োজন সামরিক অভ্যুত্থান না হওয়ার অন্যতম নিয়ামক। একইসাথে ভারতের আয়তন, ভৌগলিক বৈচিত্র্য ও জটিল রাষ্ট্র পরিচালন অবকাঠামোর কারণে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে এই বিরাট দেশকে নিয়ন্ত্রন করা বেশ কঠিন। কোনো বাহিনীর পক্ষে কেবল দিল্লীর ক্ষমতা দখল করে ভারতের প্রায় ২৯টি রাজ্য এবং ৬টি কেন্দ্র শাসিত অ ল এবং এগুলোর মুখ্যমন্ত্রীগণকে পরিচালনা করা এক কথায় অসম্ভব।

স্বাধীন ভারতের পথচলার শুরু থেকেই সঠিক কৌশল এবং পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত ‘কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল’ কাঠামোসহ গৃহীত নানান পদক্ষেপ ভারতীয় সেনাবাহিনীকে করেছে ‘ক্যু-প্রতিরোধক’। ফলশ্রুতিতে ভারতে সামরিক অভ্যুত্থান হওয়া খুবই দুরুহ ব্যাপার বলেই মনে হয়। 

লেখক- এইচ. এম. এ. হক (বাপ্পি), মেইল- hmahaque.ju@gmail.com

বাংলাদেশ জার্নাল/এএম

© Bangladesh Journal


from BD-JOURNAL https://www.bd-journal.com/other/184374/ভারত-যেদেশে-সেনা-অভ্যুত্থান-হয়-না