পৃথিবীটা কোনো যুদ্ধক্ষেত্র নয়, প্রাণের আবাসস্থল!

পৃথিবীটা কোনো যুদ্ধক্ষেত্র নয়, প্রাণের আবাসস্থল!

পৃথিবীটা কোনো যুদ্ধক্ষেত্র নয়, প্রাণের আবাসস্থল!

দেশ ভরা নেতা আছে কিন্তু নেতার অনুসারী নেই। নেতা তার মনুষ্যত্ব, লজ্জা শরম এবং বিশ্বস্ততা হারিয়েছে। নেতা বলছেন কি করতে হবে কিন্তু কে কার কথা শোনে। জনগণ বুঝে গেছে নেতার নেতৃত্বের সুযোগ করে দিলে সে করবে পরিবর্তন নিজের এবং পরিবারের।

অন্যান্য

রহমান মৃধা

দেশ ভরা নেতা আছে কিন্তু নেতার অনুসারী নেই। নেতা তার মনুষ্যত্ব, লজ্জা শরম এবং বিশ্বস্ততা হারিয়েছে। নেতা বলছেন কি করতে হবে কিন্তু কে কার কথা শোনে। জনগণ বুঝে গেছে নেতার নেতৃত্বের সুযোগ করে দিলে সে করবে পরিবর্তন নিজের এবং পরিবারের।

জনগণ তো এখন আগের মত বোকা নেই, যখন যার যা খুশি বলবে আর তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে। সে দিন গুজার গিয়া। একটি গানের কলি মনে পড়ে গেল “দয়াল বাবা কলা খাবা গাছ লাগাইয়া খাও।” কই দেশের প্রতি যদি সত্যিই এত দরদ তাহলে আগের সেই শহীদ ভাইদের মত করে কেন আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ছিনা? কারণ আমরা জনগণ বার বার শুধু জর্জরিত, শোষিত, নিপীড়িত এবং নির্যাতিত। আমাদের ভালোবাসা ঘৃণায় পরিণত হয়েছে। হতাশায় নিমজ্জিত আমাদের সমস্ত শরীর।

একটু তাকিয়ে দেখেন, গত পঞ্চাশ বছরে আমাদের দেশে প্রকৃতির কী কী পরিবর্তন হয়েছে। কতটুকু বনভূমি উজাড় হয়েছে, এর সঙ্গে কী কী প্রাণের বিলুপ্তি ঘটেছে, নতুন করে কী পরিমাণ শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে। আমাদের দেশের বাতাস, মাটি ও পানি কী পরিমাণ দূষণ হয়েছে। মানবতাসহ মানুষের সামগ্রিক মূল্যবোধে কী পরিমাণ ঘাটতি দেখা দিয়েছে। মিথ্যা কতটা সহজলভ্য হয়ে উঠেছে! অস্থিরতার সঙ্গে অসহনশীলতার দাপট বেড়ে যাচ্ছে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে! করোনার এই সময়ে ব্যাপক প্রাণহানি থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অর্থনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক- সব পর্যায়েই বিশ্বজুড়ে বিপর্যয় নেমে এসেছে। পৃথিবীতে করোনা মহামারিতে ৪৫ লাখের বেশি মানুষ মারা গেছে এবং মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা উল্লিখিত সংখ্যার দ্বিগুণও হতে পারে। চলছে জীবন রক্ষাকারী ভ্যাকসিন নিয়ে রাজনীতি ও ব্যবসা! ঘটছে মানবতায় ভয়াবহ বিপর্যয়। বিশ্বব্যাপী শুরু হয়েছে এক ভিন্নধর্মী অরাজক পরিস্থিতি! চরম সমন্বয়হীনতা বিরাজ করছে রাষ্ট্র, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থায়! বিশ্বের এই ক্রান্তিকালে মানুষের জীবন যখন ঝরে পড়ছে, তখন আমাদের সমন্বয়হীনতা সত্যিই চরম উদ্বেগের!

লন্ডন বা ঢাকার লাক্সারি পরিবেশে বসে যে সব নেতারা অর্ডার করছে কি করতে হবে তাদের কথা কেও আর শুনছে না। বর্তমানে ক্ষমতায় যে সরকার তার কথাও জনগণ শুনছে না। সরকারের বেতনভুক্ত কর্মচারীরা তাদের রুটিন অনুযায়ী কাজে হাজিরা দিচ্ছে মাত্র। দেশের রাজনীতিতে শুধু ধান্দাবাজি, যার কারণে নেতার পেছনে কোনো অনুসারী নেই, আছে শুধু চামচারা।

সেক্ষেত্রে জনগণের কি হবে? হয়ত সবাই বলবে তাহলে মিটিংয়ে নেতার বক্তৃতা শুনতে এতলোক জড়ো হয় কেন? জড়ো হবার অর্থ এই নয় যে নেতা যা বলছেন জনগণ সেভাবে কাজ করছে। জনগণ স্ট্রিট স্মার্ট, তাই তারা চোখ কান খোলা রেখে সব শুনছে, দেখছে এবং তারপর তাদের সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছে।

মন বলে শোষণ, শাসন আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠে সোচ্চার হই আর ঝাঁপিয়ে পড়ি কিন্তু না, এখন আমি ভিতু হয়ে গেছি, প্রতিবাদ করতে ভুলে গেছি আর অপমান সইতে শিখেছি। নীতিহীন এবং পথভ্রষ্ট নেতার নেতৃত্বের কারণে আমি এখন নিজের দেশে পরাধীন। আমাদের নেতা আছে তবে নেই নেতৃত্ব।

শুধু বাংলাদেশ নয় পুরো পৃথিবীর দিকে তাকান। দেখুন, নদীর পানিতে কতটা দূষণ ধরেছে, বিশ্বব্যাপী কতগুলো নদী বিলীন হয়ে গেছে, কতটুকু বন উজাড় হয়েছে, বাতাসের তাপমাত্রা কতটা বেড়েছে, সামগ্রিকভাবে প্রকৃতি কতটা দূষণ হয়েছে। বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলে দেখুন, জানতে পারবেন প্রকৃতি দূষণে পুরো বিশ্বে কী ধরনের প্রভাব পড়বে।

অস্ত্র ব্যবসার নামে ভাড়াটে যুদ্ধে আমরা কাদের স্বার্থ রক্ষা করছি! একদিকে দেশের মানুষের জীবন যেমন বিপন্ন হয়ে উঠছে, তেমনি অন্য দেশের মানুষের প্রতি বেড়ে উঠছে চরম ঘৃণা। দুটোই মানবতার জন্য ভয়ানক এক হুমকি, ফলে বিশ্বব্যাপী বেড়ে যাচ্ছে অস্থিরতা। নিজের দেশে জীবন-জীবিকার অভাবে, এমনকি প্রাণ রক্ষার্থেও মানুষ সাগর পাড়ি দিয়ে চলে যাচ্ছে অন্য দেশ। যে পৃথিবী প্রাণের আবাসস্থল, আজ সেই পৃথিবীতেই মানুষ প্রাণ বাঁচানোর তাড়নায় সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছে সাগরে!

আমরা ভালো করেই জানি, অস্তিত্বহীন মানুষ হচ্ছে সবচেয়ে ভয়ানক মারণাস্ত্র, আত্মঘাতী হামলাসহ যে কোনো ধরনের আঘাত করতে ওরা মরিয়া হয়ে ওঠে। ওদের লক্ষবস্তু আর কিছু নয়, সাধারণ মানুষের জীবন! পৃথিবী দিন দিন হয়ে উঠছে শুধু ব্যক্তি কেন্দ্রিক ব্যবসা কেন্দ্র, অথচ পৃথিবীর থাকার কথা সুন্দর একটি প্রাণকেন্দ্র হয়ে! দিনে দিনে সাধারণ মানুষের জীবন জিম্মি হয়ে যাচ্ছে রাষ্ট্রের কাছে! একই সঙ্গে পৃথিবীতে দেখা যাচ্ছে শোষণ এবং বিত্তশালীদের ভোগবিলাসের মহোৎসব! 

সবচেয়ে দুর্ভাবনার এবং আতঙ্কের বিষয় হলো বিশ্ববাজারে নারীকে এখনও পণ্য হিসেবে কিনতে পাওয়া যায়। যে নারীর গর্ভে আমাদের জন্ম, সেই নারী এখন ব্যবসায়িক পণ্য হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো, বিশ্বব্যাপী কিছু কিছু নারীকে এভাবেই ব্যবহার করা হচ্ছে মানুষের বিকৃত মনোবাসনা পূরণের উপজীব্য হিসেবে।  ইন্টারনেট ও মিডিয়া জগতের কারণে নারীকে ঘিরে বিকৃত বাসনা ছড়িয়ে যাচ্ছে বিশ্বব্যাপী! শিশু থেকে বৃদ্ধের অনেকেই এই বিকৃতির শিকার! 

বিশ্বব্যাপী সমাজগুলোতে দেখা যাচ্ছে নারীকে ঘিরে নানা অনাচার ও দুর্ঘটনা! দায়িত্বজ্ঞানহীন স্বাধীনতার নামে নারী ও পুরুষ দুটো দলই হয়ে যাচ্ছে বিভ্রান্ত। ইন্টারনেট ও মিডিয়া জগতের যথেচ্ছ ব্যবহারে মানসিক ও শারীরিক বিকৃতি ছড়িয়ে যাচ্ছে দিন দিন। ফলে বিশ্বব্যাপী দেখা যাচ্ছে নারী-পুরুষের সম্মিলিত শারীরিক ও মানসিক অপরাধ প্রবণতা, নারী বা পুরুষ কেউই যেন কারোর কাছে নিরাপদ নয়! 

অন্যদিকে যথার্থ স্বাস্থ্য জ্ঞানের অভাবে মানুষ জড়িয়ে যাচ্ছে অনিরাপদ খাদ্যাভ্যাসে। বিশ্বের মধ্যে স্থূলতা নামে নতুন একটি মহামারি খুবই আসন্ন হয়ে পড়েছে। এখানেও ব্যবসায়ী মহলসহ রাষ্ট্র, মিডিয়া, ইন্টারনেট এবং মাদক ভীষণভাবে দায়ী। মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সব ধরনের অপরাধ। একই সঙ্গে পৃথিবীটা হয়ে পড়েছে অস্ত্র ও অবৈধ অস্ত্রের পাইকারি বাজার! 

শিক্ষার অভাব ও অর্থলিপ্সার সঙ্গে যখন মানসিক ভারসাম্যহীনতা যোগ হয়, তখন একটি অস্ত্রই হয়ে ওঠে মানবতার জন্য চরম হুমকি ও বিশ্বের অনেক দেশকেই প্রতিনিয়ত এর খেসারত দিতে হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী চোরাচালান যেন বৈধতা পেয়ে যাচ্ছে, এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সীমান্ত হত্যা। কিন্তু কোনো মৃত্যুই যেন আমাদের মনে দাগ কাটছে না। যেখানে অস্বাভাবিক একটি মৃত্যুই মানবতার ভিত নাড়িয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট হওয়ার কথা। 

পৃথিবী ক্রমে ক্রমে বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে। এর প্রধান কারণ মানুষের ভেতর প্রকৃত সু-শিক্ষার অভাব।বর্তমান প্রেক্ষাপটে মানুষকে যথার্থ সু-শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে এবং প্রকৃতির ভারসাম্যের দিকে নজর দিতে হবে। সাধারণের মধ্যে সু-শিক্ষার বোধ জাগিয়ে তুলতে হবে। তাদের বুঝাতে হবে, শুধু বিশ্বের নেতারাই নেতা নন, এই বিশ্বের প্রতিটি মানুষই এক-একজন বিশ্বনেতা। বিশ্বনেতা মানেই শুধু ক্ষমতার প্রয়োগ আর ক্ষমতার অপ্রয়োগ নয়। 

সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে, আমাদের নিজেদের সফল অভিজ্ঞতা। বিশ্বনেতা হতে হলে পৃথিবীর যত্ন নেওয়া শিখতে হবে, বিশ্বনেতা মানেই মানুষের সঙ্গে অন্যান্য প্রাণী অর্থাৎ পুরো প্রকৃতির যত্ন নিতে শিখা। নিজে আলোকিত হয়ে উঠতে হবে, বিশ্ববাসীকে আলোকিত করে জাগিয়ে তুলতে হবে। 

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে যিনিষটা সেটা হলো  সু- শিক্ষাসহ সব ধরনের মৌলিক অধিকার মানুষের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে। যে অস্থিরতার কারণে মানুষ নিজের দেশেই যেমন অসহায়, তেমনি অন্যদের জন্য যেন আতঙ্ক না হয়ে উঠতে পারে, তার দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, এই পৃথিবীটা সবার, অন্যের স্বস্তি নিশ্চিত করে সুন্দরভাবে বাঁচার অধিকার প্রতিটি মানুষেরই আছে। নিজ নিজ দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সচেষ্ট হতে হবে। সমন্বয়ের সঙ্গে নিয়ন্ত্রিত সম্পদ ব্যবহারেও সচেষ্ট হতে হবে। চোরাচালান এবং মাদকের ব্যাপারে সম্মিলিতভাবে কঠোর হতে হবে। যে করেই হোক, সীমান্ত হত্যা বন্ধ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, এই সুন্দর পৃথিবীটা কোনো যুদ্ধক্ষেত্র নয়, এই সুন্দর পৃথিবীটা হলো প্রাণের আবাসস্থল! 

আগামী বছরগুলোর মধ্যে প্রাকৃতিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার জন্য সম্মিলিত উদ্যোগের এটাই সময়। প্রকৃতির যে দূষণ এবং ক্ষতি এত বছর ধরে হয়েছে, এই দূষণ এবং ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার সহজ এবং দ্রুত কোনো পদক্ষেপ ফলপ্রসূ হবে না। 

দরকার বৈশ্বিক উদ্যোগ। একই সঙ্গে নিজ নিজ দেশের প্রতিটি মানুষের মধ্যে জাগিয়ে তুলতে হবে দায়িত্ববোধ এবং আশার আলো, তারাও যেন নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিশ্বনেতার দায়িত্ব পালন করতে পারে। 

আমি মনে প্রাণে আশা করি আমাদের সম্মিলিত উদ্যোগে অচিরেই দেশের তথা পৃথিবীর প্রাণ হয়ে উঠবে স্বতঃস্ম্ফূর্ত, দূষণ থেকে মুক্তি পেয়ে প্রকৃতি ফিরে পাবে তার পুরোনো জৌলুস। আর সু-শিক্ষার আলোতে প্রতিটি মানুষই হয়ে উঠবে এক-একজন সহনশীল এবং মানবিক বিশ্বনেতা! 

লেখক: সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন

বাংলাদেশ জার্নাল/একে/এমজে

© Bangladesh Journal


from BD-JOURNAL https://www.bd-journal.com/other/181571/পৃথিবীটা-কোনো-যুদ্ধক্ষেত্র-নয়-প্রাণের-আবাসস্থল