প্রতারকের খপ্পরে প্রাথমিকের টাকা

প্রতারকের খপ্পরে প্রাথমিকের টাকা

প্রতারকের খপ্পরে প্রাথমিকের টাকা

মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, যারা টাকা খুইয়েছেন তারা আর ফেরত পাবে না

আসিফ কাজল

মাদারীপুর জেলার কালকিনি উপজেলার ৩২ নম্বর কালাই সরদারের চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ম ও ৪র্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী সাফা ও আরাফ। সম্পর্কে ভাই-বোন। গত ১৭ মার্চ তাদের বাবা আল আমিন খানের নম্বরে এই দুই শিক্ষার্থীর উপবৃত্তির ৯০০ টাকা আসে। পরে উপবৃত্তির টাকা তুলতে গেলে দোকানি জানায়, তার একাউন্টে কোনো টাকা নেই!

আল আমিন খান অভিযোগ করে বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, ‘নগদ থেকে টাকা আসার ৫ মিনিট পর (০১৮৪২৬৫৯১৯৪) নম্বর থেকে আমার কাছে ফোন আসে। ওপাশ থেকে বলা হয় আপনার ফোনে উপবৃত্তির টাকা গেছে। লাইন না কেটে চেক করে জানান। আমি ভেবেছিলাম এটি নগদ অফিসের লোক। এরপর ফোন কেটে দেওয়া হয়। দোকানে গিয়ে দেখি আমার একাউন্টে কোনো টাকা নেই।’

জানা যায়, প্রায় এক বছর পর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির টাকা নগদের মাধ্যমে অভিভাবকদের মোবাইল একাউন্টে যাচ্ছে। কিন্তু নগদ একাউন্টে টাকা আসার পর সে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি প্রতারক চক্র। সারাদেশে এখন পর্যন্ত অন্তত হাজারের বেশি এমন ঘটনা ঘটেছে।

এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশের প্রায় প্রতিটি উপজেলার সরকারি প্রাথমিকে এমন প্রতারণার শিকার হয়েছেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। কুষ্টিয়ার দৌলতপুর, নাটোরের বরাইগ্রাম, মৌলভীবাজার সদর, নরসিংদীর রায়পুরা, টাঙ্গাইলের গোপালপুর, ময়মনসিংহের গৌরীপুর, বাগেরহাটের শরণখোলাসহ দেশের প্রতিটি উপজেলার বেশকিছু প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। সিলেটের দক্ষিণ সুরমায় এমন ঘটনার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।

উপবৃত্তি প্রকল্পের কর্মকর্তারা বলেন, চলতি বছর থেকে শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি বিতরণে রূপালী ব্যাংকের শিওর ক্যাশ বাদ দিয়ে বাংলাদেশ ডাক বিভাগের ডিজিটাল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস ‘নগদ’র মাধ্যমে বিতরণের চুক্তি হয়েছে। সরকার তিন মাস অন্তর (এক কিস্তি) উপবৃত্তি প্রদানে ৪৫০ কোটি টাকা শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করে। ইতোমধ্যে এক কিস্তির টাকা ‘নগদ’র মাধ্যমে বিতরণ করা হয়েছে। এরই মধ্যে প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে। যা অবশ্যই উদ্বেগজনক।

মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, যেসব শিক্ষার্থী উপবৃত্তির টাকা খুইয়েছেন তারা আর তা ফেরত পাবে না।

প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষক আনিসুল কবির আখিল জানান, এসব প্রতারক চক্রকে ধরা না গেলে প্রতারণা চলতেই থাকবে। সাধারণত ৪৫০ টাকার জন্য কেউ আইনের আশ্রয় নিতে চায় না। প্রশাসন ও সেবা-দাতা কর্তৃপক্ষ সদিচ্ছা প্রকাশ না করলে এমন প্রতারণা ঠেকানো অসম্ভব।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, সারা দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ুয়া প্রায় এক কোটি ৪০ লাখ শিশুকে নিয়মিত উপবৃত্তি দেয় সরকার। অধিদপ্তরের আওতাধীন ‘প্রাথমিক শিক্ষার জন্য উপবৃত্তি প্রকল্প’র (তৃতীয় পর্যায়) আওতায় এক কোটি ২১ লাখ পরিবার এ সুবিধা পাচ্ছে। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মাসে ১০০ টাকা এবং প্রাক-প্রাথমিকে মাসে ৫০ টাকা করে শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি দেয়া হচ্ছে। প্রতি তিন মাসে কিস্তি হিসেবে বছরে চার কিস্তিতে উপবৃত্তির টাকা শিক্ষার্থীর অভিভাবকের মোবাইল ফোনে এ টাকা দেয়া হয়। 

শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির টাকা হাতিয়ে নেওয়ার বিষয়ে একাধিক অভিভাবক অভিযোগ করে বলেন, এ ঘটনার সঙ্গে ‘নগদ’ কিংবা শিক্ষা অফিসের যোগসাজশ থাকতে পারে। কারণ, আমার ফোনে টাকা আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রতারকের ফোন কল আসছে। এটা কিভাবে সম্ভব! আপনার ফোনে কখন টাকা আসছে যাচ্ছে এ বিষয়টা কি কারো বলা সম্ভব বলে প্রশ্ন করেন তারা।

এ বিষয়ে ‘প্রাথমিক শিক্ষার জন্য উপবৃত্তি প্রকল্প’র (তৃতীয় পর্যায়) প্রকল্প পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) ইউসুফ আলী বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত ১৪৯টি অভিযোগ পেয়েছি। যা মোট শিক্ষার্থীর হিসেবে খুবই নগণ্য। তবে বিষয়টি আমরা মোটেও হালকা-ভাবে দেখছি না। এ বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মো. জাকির হোসেনের সঙ্গেও আলোচনা করেছি। প্রতি জেলা ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আর  বিষয়টি টেকনিক্যালি প্রতিরোধ করতে নগদকেও বলা হয়েছে।’

অনেক অভিভাবক অভিযোগ করেছেন, এই প্রতারণার সঙ্গে নগদের কোন ব্যক্তি জড়িত? এ প্রশ্নে অতিরিক্ত সচিব ইউসুফ আলী বলেন, ‘এমন সন্দেহ আমরাও করেছি এবং নগদ জানিয়েছে তদের বেশকিছু এজেন্টের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এবার এক কিস্তির টাকা দিয়েছি। এরপর একসঙ্গে দুই কিস্তির টাকা দেয়া হবে। তখন টাকার পরিমাণটাও বাড়বে।’

তবে এ ঘটনায় এজেন্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন ডিজিটাল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস ‘নগদ’র প্রধান জনসংযোগ কর্মকর্তা জাহিদুল সজল।

তিনি বলেন, ‘এই বিষয়ে কোনও এজেন্টের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অ্যাপস ও মোবাইলে টাকা উত্তোলনে বেশি চার্জ নেওয়ায় তিনজন এজেন্টকে বিভিন্নভাবে শাস্তি দেয়া হয়েছে। আমরা সবাইকে অনুরোধ করবো কেউ যেন নগদের পিন নম্বর শেয়ার না করে।’

শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির টাকা খোয়ানোর বিষয়ে মনিটরিং করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

বাংলাদেশ জার্নাল/একে/কেআই

© Bangladesh Journal


from BD-JOURNAL https://www.bd-journal.com/education/154229/প্রতারকের-খপ্পরে-প্রাথমিকের-টাকা