ঐতিহ্য নিয়ে এখনো টিকে আছে ‘আলাউদ্দিন সুইটমিট’

ঐতিহ্য নিয়ে এখনো টিকে আছে ‘আলাউদ্দিন সুইটমিট’

ঐতিহ্য নিয়ে এখনো টিকে আছে ‘আলাউদ্দিন সুইটমিট’

আশির দশকে ঢাকাকে উপস্থাপনের হাতেগোনা কিছু আইকনিক প্রতিষ্ঠানের একটি ‘আলাউদ্দিন সুইটমিট’। বাংলাদেশে ব্র্যান্ড মিষ্টির পথ দেখানো সেই আলাউদ্দিন সুইটমিট এখন অনেকটা...

নিলুফা খানম

১৯৮৮-১৯৮৯ সালে বিচিত্রা পত্রিকার পুরো একটি পাতাজুড়ে থাকত ভীষণ মজার এক কার্টুন। এই কার্টুনের চরিত্রগুলোর পাশে লেখা থাকতো মিষ্টি মিষ্টি নানা কথা। হ্যাঁ, এভাবেই পত্রিকায় আলাউদ্দিনের মিষ্টির বিজ্ঞাপন দেয়া হতো। আশির দশকে ঢাকাকে উপস্থাপনের হাতেগোনা কিছু আইকনিক প্রতিষ্ঠানের একটি ‘আলাউদ্দিন সুইটমিট’। বাংলাদেশে ব্র্যান্ড মিষ্টির পথ দেখানো সেই আলাউদ্দিন সুইটমিট এখন অনেকটা গতি হারিয়ে ঐতিহ্য নিয়ে কোনোরকমে টিকে আছে। ঢাকার বুকে কোথায় আছে সেই মিষ্টির দোকান, বেচা-বিক্রি কেমন?

বাংলাদেশ জার্নালের পাঠকদের জন্য আজ তা তুলে ধরছি-

সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে বাঙালিরা বিদেশে চাকরি এবং বসবাসে উৎসাহী হয়। ফলে বাঙালিদের বিদেশে যাতায়াত শুরু হয়ে যায়। বিদেশ যাত্রী বাঙালিরা যাতে বাংলাদেশের ফ্রেশ মিষ্টি নিয়ে যেতে পারে সেই লক্ষে ঢাকা বিমানবন্দরের কাছে আলাউদ্দিন একটি বড় দোকান খোলেন। আলাউদ্দিনের মিষ্টির মান ছিলো স্বাস্থ্যকর এবং অন্যতম সেরা। কোয়ালিটি এবং বৈচিত্র্য থাকায় অনেকেই এসব মিষ্টি দেশের বাইরে নিয়ে যেতেন। দেশের বাইরেও আলাউদ্দিনের মিষ্টির জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে।

ঢাকার মিষ্টির জগতে দীর্ঘদিন রাজত্ব করা সেই ‘আলাউদ্দিন সুইটমিট’র ব্যবসা এক দশক আগে প্রায় চার বছর বন্ধ ছিলো। এর পর নতুন হাতে আলাউদ্দিন সুইটমিট ফিরে এলেও এখনো চলছে টিকে থাকার লড়াই। আর সেই টিকে থাকার লড়াইয়ে রয়েছে ঐতিহ্যের পরশ। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে জৌলুস হারাতে শুরু করে আলাউদ্দিন সুইটমিট, নতুন শতাব্দীতে ব্যবসায়িক মন্দা তীব্রভাবে দেখা দেয়। ২০০২ সালের পর ২০০৫ সাল পর্যন্ত কোনোমতে ব্যবসা চললেও এরপর চার বছর আলাউদ্দিন সুইটমিটের সমস্ত দোকান বন্ধ হয়ে যায়। তবে ২০০৯ সালে আবার ফিরে আসে এই মিষ্টি, ঢাকায় ফের চালু হয় সাতটি শাখা। দেশের বাইরে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে আছে চারটি শাখা।

ছবি ১: আলাউদ্দিন সুইটমিট (সংগৃহীত)

দেশবিখ্যাত এই মিষ্টির জন্ম যেখান থেকে, সেই পুরান ঢাকার চকবাজারের আগের জায়গায় এখনো রয়েছে আলাউদ্দিন সুইটমিটের প্রধান শাখা। ব্যবসার হাল ধরেছে চতুর্থ প্রজন্ম। বদলেছে মিষ্টির ধরন, প্যাকেটের নকশা। প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে নেয়া হয়েছে ডিজিটাল বিপণন কৌশল।

ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, দেড়শো বছরের কিছু বেশি আগে ভারতের লখনৌ থেকে পুরান ঢাকার চকবাজারে আসেন মিষ্টি ব্যবসায়ী আলাউদ্দিন হালওয়াই। তিনি ১৮৯৪ সালে গড়ে তোলেন আলাউদ্দিন সুইটমিট, যা ছিলো ঢাকা শহরের বুকে প্রথম খ্যাতি ছড়ানো মিষ্টির দোকান।

ছবি ২: উত্তর আমেরিকায় আলাউদ্দিন সুইটমিট (সংগৃহীত)

কেবল মিষ্টির ব্যবসাই নয়, আলাউদ্দিন সুইটমিটের নাম জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গেও। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট থেকেই নকশায় থিম হিসেবে বেছে নেয়া হয় ‘অ’-কে। তবে আদি রঙ ও ডিজাইনের প্যাকেটের পরিবর্তে এখন আলাদা ধরনের প্যাকেটেও বিক্রি হচ্ছে এই মিষ্টি।

আলাউদ্দিন সুইটমিটের বর্তমান পরিচালক মারুফ আহমেদ। আলাউদ্দিনের নাতির মেয়েকে ২০০৯ সালে বিয়ে করে অংশ হয়েছেন এই পরিবারের, সেই সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী ব্যবসার। তিনি জানান, আমাদের পুরোনো প্রতিষ্ঠান। আগের দিনে মিষ্টির ব্যবসা ছিলো হোটেল বেইজড, মিষ্টির দোকান হিসেবে আমরাই প্রথম শুরু করি। প্রতিষ্ঠার সময় তিন দেশ মিলিয়ে ছিলো ভারতীয় উপমহাদেশ। এরপর আলাউদ্দিন সাহেব মারা গেলেন। তার ছেলেরা দায়িত্ব নিলেন, তারপর আমার শ্বশুর। কিন্তু ২০০২’র দিকে শ্বশুর মারাত্মক অসুস্থ হয়ে গেলেন। ২০০৯ সালে আমি এ পরিবারে বিয়ে করি, এরপর একা হাতে আবার সব শুরু করি।

ছবি ৩: আলাউদ্দিন সুইটসের বর্তমান স্বত্বাধিকারী এবং আলাউদ্দিন হালওয়াই পরিবারের চতুর্থ প্রজন্মের সদস্য মারুফ আহমেদ।

‘আলাউদ্দিন সুইটমিট’ হারিয়ে যাওয়ার নেপথ্যে কী? জানতে চাইলে মারুফ জানান, এই কোম্পানি এক সময় ছিলো পরিবারকেন্দ্রীক। বাইরের কোনো অংশীদার ছিলো না। একা একা ব্যবসা পরিচালনার কারণে সমস্যা দেখা দেয়। একজন অসুস্থ হলে তো পুরো ব্যবসা বন্ধ হতে পারে না। এমন না যে ব্যবসা করতে পারতেছি না, তবে একা একা ব্যবসা করা খুব কঠিন। তা ছাড়া আমাদের পূর্বপুরুষেরা সেভাবে শিক্ষিত ছিলো না। এই কারণে মূলত আমাদের পিছিয়ে পড়তে হয়েছে। অন্য কোনো কারণ নেই।

ব্যবসায় ধস নামলেও গুণগত মানে আলাউদ্দিন সুইটমিট এখনো অনন্য বলে দাবি করছেন মারুফ আহমেদ। তিনি বলেন, আমাদের তিনটা ফ্যাক্টরি আছে, তিন স্থানেই মিষ্টি তৈরি হয়। আমরা গুণগত মান ধরে রাখার চেষ্টা করি। আমাদের বিশেষত্ব হলো আমরা কোনো প্রোডাক্টে প্রিজারভেটিভস ইউজ করি না।

ছবি ৪: আলাউদ্দিন সুইটমিট (সংগৃহীত)

আমাদের মিষ্টি নিবেন, দুই দিন পর নষ্ট হবে। কারণ, আমরা কোনো আর্টিফিশিয়াল প্রিজারভেটিভস ইউজ করি না। আগে আলাউদ্দিন সুইটমিটে মাত্র কয়েক ধরনের মিষ্টি থাকলেও এখন সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়েছে বলেও জানান মারুফ।

মারুফ আরো জানান, এই মহামারী ভীষণভাবে আক্রান্ত করেছে আমাদের। প্রতিবছর রমজান মাসে আমরা ইফতার পার্টি গুলোতে লাগাতার ক্যাটারিং’র অর্ডার পেতাম, ঘরোয়া অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান ও সরকারি অনুষ্ঠানগুলো থেকেও অর্ডার আসতো। কিন্তু এই বছর মহামারীর কারণে আমাদের কাছে কোনো অর্ডার আসেনি। তারপরেও এই অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মাঝে আমরা বেশীরভাগ কর্মী ধরে রেখেছি। আমাদের এমনও দিন গেছে যখন আমরা কিছুই বিক্রি করতে পারিনি, তবুও আমরা এখনো আমাদের কোন কর্মচারীকে ছাটাই করিনি।

ছবি ৫: আলাউদ্দিন সুইটমিট (সংগৃহীত)

আলাউদ্দিনের উত্তরাধিকার একটি বিশ্বস্ত অবস্থান তৈরি করতে পেরেছেন যার ফলে এটি আন্তর্জাতিক চাহিদার একটির নির্ভরশীল অংশে পরিণত হয়েছে। আলাউদ্দিন সুইটমিটের ব্যবসায়িক পরিকল্পনা এখন বিদ্যমান কারখানাগুলিকে আধুনিকীকরণ এবং সম্ভব হলে আরো সম্প্রসারণ করা। এই মিষ্টি ফুডপান্ডা এবং পাঠাওসহ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে কাজ শুরু করেছে। কিন্তু তারা এখনো তাদের ফেসবুক পাতার মাধ্যমে অর্ডার নেয়া শুরু করতে পারেনি। তবে এখন ফোন কলের মাধ্যমে অর্ডার করা যায়।

ঐতিহ্যবাহী আলাউদ্দিন সুইটমিটের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য মিষ্টির মধ্যে রয়েছে- রসগোল্লা, স্পঞ্জ রসগোল্লা, লালমোহন, চমচম, গুড়ের সন্দেশ, কালোজাম, মালাইকারী, মালাইচম, রাজভোগ, দই, হাফসি হালুয়া, দুদিয়া সন্দেশ, কাঁচা সন্দেশ, দই, রসমালাই ইত্যাদি। রোজার সময় চকবাজার শাখায় পাওয়া যায় মন ভোলানো আলাউদ্দিন স্পেশাল জাফরানী সরবত। এ ছাড়াও রমজানে ইফতারের আয়োজনে আলাউদ্দিনের থাকে কিমা পরোটা, টানা পরোটা, জালি কাবাব, বিফ স্টিক, চিজ লরেন্স, চিকেন স্টিক, চিকেন নাগেট আর পনির সমুচা। এর মধ্যে কিমা পরোটা আর চিস লরেন্সের চাহিদা ব্যাপক।

ছবি ৬: আলাউদ্দিন সুইটমিট (সংগৃহীত)

আলাউদ্দিন সুইটস লাচ্ছা সেমাই ঈদের সময় সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং ভারতসহ আরো বেশ কিছু দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে।

১৫৬ বছরের পুরনো এই দোকানটি আজকের দিন পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশের সকল সামাজিক-রাজনৈতিক উত্থান পতনের সাক্ষী। ভারত-পাকিস্তান ভাগের পর ঢাকা ও লখনৌ এর মাঝে প্রথম স্থাপিত হয় সীমানার কাঁটাতার, কিন্তু তা আলাউদ্দদিন সুইটস-এর ব্যবসার জন্য তেমন কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। বর্তমানে আলাউদ্দিন সুইটস সাভার ও গাজীপুরে দুটি এতিমখানা ও মাদ্রাসা পরিচালনা করে। প্রতিষ্ঠানটির সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে কিছু স্কুল-মসজিদ এখনো পরিচালনা করে আসছে।

ছবি: ৭ আলাউদ্দিন সুইটমিট (সংগৃহীত)

নানা উত্থান-পতনের মধ্যে আজো দাপটের সাথে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে আলাউদ্দিন সুইটমিট লিমিটেড। ঢাকার পুরনো মিষ্টির দোকানগুলোর মধ্যে, আলাউদ্দিন সুইটমিট এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

বাংলাদেশ জার্নাল/এনকে

© Bangladesh Journal


from BD-JOURNAL https://www.bd-journal.com/life-style/history-heritage/151097/ঐতিহ্য-নিয়ে-এখনো-টিকে-আছে-আলাউদ্দিন-সুইটমিট