বাড়ছে পরিবেশগত ঝুঁকি

বাড়ছে পরিবেশগত ঝুঁকি

বাড়ছে পরিবেশগত ঝুঁকি

সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্লাস্টিক জড়িয়ে পড়ছে। আরামদায়ক ও সুলভ মূল্যের হওয়ায় এর ব্যবহার প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে...

জার্নাল ডেস্ক

সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্লাস্টিক জড়িয়ে পড়ছে। আরামদায়ক ও সুলভ মূল্যের হওয়ায় এর ব্যবহার প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। বহুমুখী ব্যবহারে সুবিধাজনক বলে প্লাস্টিক মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে প্রভাব বিস্তার করে আছে। দেশে অনলাইন ফুড ডেলিভারিতেও বর্তমানে প্লাস্টিকের ব্যবহার বেড়েছে। বিশেষ করে মহামারি করোনায় রেস্তোরাঁর চেয়ে বাসায় খাবার খেতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছেন অনেকে। ফুডপান্ডা, হাংগ্রি নাকি, সহজ ফুড, পাঠাও, ই-ফুড, ফুড পিয়ন, হেলদি কিচেনের মতো অ্যাপ ব্যবহার করে খাবার অর্ডারের প্রবণতা বেড়েছে। খাবার সরবরাহে ব্যবহার করা হচ্ছে প্লাস্টিকপণ্য। অথচ পরিবেশ দূষণের জন্য যেসব বস্তু দায়ী তার অন্যতম প্রধান হচ্ছে পলিথিন বা প্লাস্টিক।

রেস্তোরাঁ, হোম কিচেন বা ক্লাউড কিচেন থেকে খাবার সরবরাহে ব্যবহার করা হচ্ছে প্লাস্টিকের বক্স ও প্যাকেট। ফয়েল পেপার বা কাগজের প্যাকেটে খিচুড়ি, কাচ্চি বিরিয়ানি, চিকেন বিরিয়ানি, গ্রিলড চিকেন, ফ্রাইড চিকেন, ফ্রাইড রাইস, বার্গার, পিত্জা ডেলিভারি করা হচ্ছে। তবে বহন সুবিধার জন্য স্যুপ বা তরল খাবার সরবরাহে প্লাস্টিকের পণ্য ব্যবহারই হচ্ছে বেশি। একবার ব্যবহারের পর এগুলো ফেলে দেয়া হচ্ছে যত্রতত্র।

অনলাইন ফুড ডেলিভারির সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মনীতি মেনেই প্যাকেজিংয়ের কথা বলছে। সাধারণত খাদ্যপণ্য প্যাকেটজাত করে থাকে রেস্তোরাঁসহ ক্লাউড কিচেনগুলো। এ বিষয়ে পাঠাওয়ের পরিচালক (বিপণন) সৈয়দা নাবিলা মাহবুব বলেন, ‘বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ফাস্টফুডের অর্ডার বেশি থাকে।’ প্যাকেজিংয়ের নিয়মনীতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘টেকওয়ের জন্য অনেক বেশি সতর্কতার সঙ্গে প্যাকেজিং করা হয়। এছাড়া আমরা ফুড ব্যাগগুলো এমনভাবে বানানোর চেষ্টা করি, যাতে তা কয়েকভাবে ব্যবহার করা যায়। তবে বিভিন্ন রেস্তোরাঁর আলাদা প্যাকেজিং রুল আছে, তারা সেভাবে খাদ্যপণ্য প্যাকেজিং করে।’ পাঠাওয়ে কভিড-পরবর্তী ক্লাউড কিচেনের সংখ্যা ৭ থেকে ৮ গুণ বেড়েছে বলেও জানান তিনি।

সহজের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মালিহা কাদিরও কভিড-পরবর্তী অনলাইন ফুড ডেলিভারির সংখ্যা বেড়েছে বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘কভিড পরবর্তী সহজ ফুড ডেলিভারি ১০ থেকে ২০ শতাংশ বেড়েছে। এর মধ্যে অংশগ্রহণও বেড়েছে ক্লাউড কিচেনের। বাংলাদেশের ফুড ডেলিভারি প্রেক্ষাপটে এটি একটা উদীয়মান ট্রেন্ড।’

ফুড ডেলিভারি খাত সূত্রে জানা যায়, দিনে গড়ে ফুড ডেলিভারি প্লাটফর্মে অর্ডার আসছে প্রায় ১ লাখ, যার অর্থমূল্য প্রায় ৩ কোটি টাকা। সেই হিসেবে বার্ষিক প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার দেশীয় বাজার রয়েছে এ খাতে।

বাংলাদেশে অনলাইন ফুড ডেলিভারি সার্ভিসে নিবন্ধিত ইউজারের সংখ্যাও বেড়েছে। পাঠাও অ্যাপের নিবন্ধিত ইউজার রয়েছে ৭০ লাখের বেশি। আর নিবন্ধিত রেস্তোরাঁর সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে ৮ হাজারের ঘর।

অনলাইন ফুড ডেলিভারিতে কাগজের প্যাকেট ব্যবহার করা হলেও শুকনো খাবার ছাড়া বাকিগুলো পলিথিনে সরবরাহ করা হয়। ওয়ান-টাইম প্যাকেজিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ উৎপাদনে একদিকে যেমন প্রচুর কাঁচামালের প্রয়োজন পড়ে, তেমনি একবার ব্যবহারের পর ফেলে দেয়া হয় বলে খুব দ্রুতই এগুলো অবজর্নার স্তূপে পরিণত হয়ে পরিবেশের ক্ষতি করছে। এ আবর্জনা পোড়ানোর সময়ও প্রচুর শক্তি খরচ করতে হয়।

মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রবার্ট ক্রফোর্ড ও তার সহযোগীরা তাদের গবেষণায় দেখেছেন, অনলাইন ফুড ডেলিভারির জন্য ব্যবহূত একক-ব্যবহারের (সিঙ্গেল ইউজ) জন্য তৈরি প্যাকেট ধ্বংসের বিপরীতে ৫ হাজার ৬০০ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড সমতুল্য সিওটু-ই গ্যাসের নির্গমন ঘটে। এছাড়া একটি প্লাস্টিকের বক্স ও ব্যাগের বিপরীতে শূন্য দশমিক ১৬ কেজি থেকে শূন্য দশমিক ২৩ কেজি সিওটু-ইর নির্গমন হয়, পিত্জার কার্ডবোর্ড বক্সের ক্ষেত্রে শূন্য দশমিক ২০ কেজি ও বার্গার জাতীয় খাবারের পেপার ব্যাগ, পেপার বক্স, প্লাস্টিক স্ট্র, লিকুইড পেপারবোর্ড কাপ ইত্যাদির ক্ষেত্রে সিওটু-ইর নির্গমনের পরিমাণ শূন্য দশমিক ২৯ কেজি। বাংলাদেশেও এটি লক্ষ্য করা যায়।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, গত বছর হাইকোর্ট সরকারকে বলে দিয়েছিলেন যে, ‘এই বছরের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে সব হোটেল-রেস্তোরাঁকে ওয়ানটাইম প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করে দিতে হবে। পাশাপাশি উপকূলীয় এলাকাগুলোতেও এর ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। হাইকোর্ট এক বছর সময় দিয়েছিল। এরপর করোনা সংক্রমণ শুরু হয়। পর্যায়ক্রমে ২০২২ এর মধ্যে ওয়ানটাইম প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করে দিতে হবে। ২০০০ সালে সরকার পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করলে স্বল্পসময়ের জন্য হলেও দেশ পলিথিন ব্যাগ মুক্ত হয়েছিল। কাজেই ফুড ডেলিভারির ক্ষেত্রেও প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধ করা সম্ভব। ফুড ডেলিভারিতে প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করার বিষয়টি খুবই সহজ। এক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ ও তদারকি বাড়াতে হবে।’

হোম কিচেন বা ক্লাউড কিচেনের ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের কাস্টমাইজ লাঞ্চ বক্স (একটি বক্সে কয়েকটি খাবার একসঙ্গে রাখা যায়) ও সাধারণ বক্সে খাবার সরবরাহ করতে দেখা যায়। কাস্টমাইজ লাঞ্চ বক্সগুলো বারবার ব্যবহার করা হচ্ছে। এটির ফুডগ্রেড মান নিয়ে সংশয় রয়েছে। তবে সাধারণ প্লাস্টিকের বক্সগুলোর জায়গা হচ্ছে ভাগাড়ে। ফুড গ্রেডেড প্লাস্টিকে খাবার মোড়কজাত না করায় স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির মাত্রাও বাড়ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এম আকতারুজ্জামান বলেন, ‘খাদ্যপণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে ফুড গ্রেডেড প্লাস্টিক ব্যবহার করা যেতে পারে। বাজারে ফুড গ্রেডেড প্লাস্টিক রয়েছে, যা কিছুটা ব্যয়বহুল। প্লাস্টিকের বিভিন্ন ক্ষতিকারক দিক রয়েছে। রাতারাতি মানুষের শরীরে এর প্রভাব দেখা না দিলে কিংবা ক্ষতি না হলেও বিভিন্ন অঙ্গে প্লাস্টিক কণা জমতে থাকে। পরবর্তী সময়ে শরীরের মলিকিউলারগুলোর সঙ্গে প্লাস্টিক মলিকিউলার প্রতিক্রিয়া করে মেটাবলিক ডিজঅর্ডার ঘটায়। এতে করে মানুষের শরীরে বিপাকীয় রোগের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে লিভার ও কিডনির ক্ষতি করে, যা একসময় ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে। তবে স্বল্প সময়ে এর প্রতিক্রিয়াগুলো বোঝা যায় না। ৮ থেকে ১০ বছর পর বড় ধরনের রোগের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়।’

ফুড ডেলিভারি ব্যবসা এখন শহরকেন্দ্রিক। তবে ব্যবসা বড় হচ্ছে। মহামারীর কারণে চাকরি হারিয়ে বা ব্যবসা বন্ধ হওয়ায় অনেকেই নতুন এ পেশার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। অনেকে যুক্ত হচ্ছেন ক্লাউড কিচেনের সঙ্গেও। তাই খাবারের মান নিশ্চিতের পাশাপাশি প্লাস্টিকের বক্সের পরিবর্তে কাগজের প্যাকেট বা পাত্রে খাবার সরবরাহের কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

এ প্রসঙ্গে ই-ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াহিদ তমাল জানান, ‘প্লাস্টিক পরিবেশবান্ধব নয়। তাছাড়া প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধের আইনও রয়েছে। ই-ক্যাবের পক্ষ থেকে আমরা বেশকিছু বিষয় চিন্তা-ভাবনা করছি। বিশেষ করে প্লাস্টিকের বদলে এখানে পাটের তৈরি পণ্য ব্যবহার করা যায় কিনা তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।’

কিছু হোম কিচেন ফুড ডেলিভারি প্লাটফর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করছে, আবার কেউ কেউ নিজস্ব ডেলিভারিম্যান দিয়ে ব্যবসা করছে। এক্ষেত্রে তাদের কীভাবে নজরদারির আওতায় আনা সম্ভব হবে এ প্রশ্নের উত্তরে আব্দুল ওয়াহিদ তমাল আরো বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ই-ক্যাব কাজ করছে। ই কমার্স সেল গঠন করা হয়েছে। কোম্পানিগুলো কীভাবে পরিচালিত হবে সে বিষয়ক গাইডলাইন তৈরি করা নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। বিশেষ করে ক্লাউড কিচেনগুলোকে কিছু নিয়মের আওতায় নিয়ে আসা উচিত। সরকারের পক্ষ থেকে যদি এ ধরনের উদ্যোগ না নেয়া হয়, তবে ভবিষ্যতে এক ধরনের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।’ সূত্র- বণিক বার্তা

© Bangladesh Journal


from BD-JOURNAL https://www.bd-journal.com/health/151096/বাড়ছে-পরিবেশগত-ঝুঁকি