রিপোর্টার থেকে সম্পাদক (পর্ব -৩৪)
রিপোর্টার থেকে সম্পাদক (পর্ব -৩৪)
টানা তিন দশক রিপোর্টার হিসাবে কাজ করেছি। এ সময় রাজনীতির অনেক উত্থান-পতন হয়েছে। অনেক ঘটনার নীরব সাক্ষীও আছি। আবার অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রিপোর্ট করেছি। রিপোর্ট নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনাও হয়েছে। অনেক স্মৃতি আছে। দুঃখ-বেদনা-আনন্দ আছে। সেগুলো এক বইয়ে লিখে শেষ করার মতো নয়। রিপোর্টার হিসেবে নেয়া আমার এমন কয়েকটি সাক্ষাৎকার এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এখানে উল্লেখ করলাম।
শাহজাহান সরদার[দেশের জনপ্রিয় দুটি পত্রিকার (যুগান্তর, বাংলাদেশ প্রতিদিন) জন্মের পেছনের ইতিহাস, কর্তৃপক্ষের চাপিয়ে দেয়া বিব্রতকর বিভিন্ন আদেশ নির্দেশ, হস্তক্ষেপ, পত্রিকা প্রকাশের ওয়াদা দিয়ে অন্য একটি জনপ্রিয় পত্রিকা থেকে নিয়ে এসে পত্রিকা না বের করে হাতজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে বিদায় দেয়া, পত্রিকা প্রকাশের পর কোন কোন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কিছু দিনের মধ্যেই ছাপা সংখ্যা কমিয়ে দিয়ে লাভ খোঁজা, ইচ্ছেমত সাংবাদিক-কর্মচারি ছাঁটাই করা সহ পত্রিকার অন্দর মহলের খবরা-খবর, রাজনৈতিক মোড় ঘুড়িয়ে দেয়া কিছু রিপোর্ট, সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটির কিছু ঘটনা এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ নিয়ে আমার এ বই ‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’। জানতে পারবেন সংবাদপত্র জগতের অনেক অজানা ঘটনা, নেপথ্যের খবর।]
(পর্ব -৩৪)
টানা তিন দশক রিপোর্টার হিসাবে কাজ করেছি। এ সময় রাজনীতির অনেক উত্থান-পতন হয়েছে। অনেক ঘটনার নীরব সাক্ষীও আছি। আবার অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রিপোর্ট করেছি। রিপোর্ট নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনাও হয়েছে। অনেক স্মৃতি আছে। দুঃখ-বেদনা-আনন্দ আছে। সেগুলো এক বইয়ে লিখে শেষ করার মতো নয়। রিপোর্টার হিসেবে নেয়া আমার এমন কয়েকটি সাক্ষাৎকার এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এখানে উল্লেখ করলাম।
এক. এরশাদ জামানার ১৯৮৬ সালের নির্বাচন নিয়ে অনেক ধরনের আলোচনা-সমালোচনা আছে। সব ধরনের আলোচনায় একটা বিষয় স্পষ্ট যে, স্বৈরাচারের ছকেই সেই নির্বাচন হয়েছিল। দুই জোট যতই আন্দোলন করুক না কেন, আর দুই নেত্রী যতই দৃঢ় থাকুন না কেন, তাদের জোটের এবং দলের নীতি-নির্ধারক পর্যায়ের কিছু নেতাকে এরশাদের অনুগত করে এক জোটকে নির্বাচনে নিয়ে আসা হয়। আরেক জোট থাকে বাইরে। দুটিই ছিল কূটচাল। এরশাদ এই চালটি খুব ভালভাবে দিতে পেরেছিলেন। শেখ হাসিনা দু’দিন আগে চট্টগ্রাম লালদীঘি ময়দানে এরশাদের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে তা পরিবর্তন করে নির্বাচনে অংশ নেয়াটা যেমন আলোচিত বেগম জিয়ার অংশ না নেয়াটাও ছিল রহস্যজনক। কেননা অনেক দাবি দাওয়া সত্ত্বেও এক পর্যায়ে দুই জোটের নির্বাচনে অংশগ্রহণের পক্ষেই মত আসে। দুই নেত্রীর মনোভাবও তেমনই ছিল। ১৫০টি করে আসনে দুই নেত্রীর অংশ নেয়ার ফর্মুলাসহ নানা ধরনের কৌশল নিয়েও আলোচনা হয়। কিন্তু বাস্তব হলো শেষপর্যন্ত বিএনপি জোট নির্বাচনে অংশ নেয়নি। আওয়ামী জোট অংশ নেয়। তবে আওয়ামী জোট থেকে ওয়ার্কার্স পার্টি এবং তৎকালীন জাসদের আরিফ-ইনুর নেতৃত্বে কয়েকটি দল ১৫ দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে আসে। তারা নির্বাচনে অংশ নেয়নি। বিএনপি-নেতৃত্বাধীন ৭ দলীয় জোটের সাথে তারা নির্বাচনবিরোধী অবস্থান নিয়ে আন্দোলন ও সংগ্রামে অংশ নেয়। এরই মধ্যে সব বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে নির্বাচন হয়ে যায়। এই নির্বাচন ছিল ব্যাপক কারচুপির নির্বাচন। প্রশাসনের প্রকাশ্য হস্তক্ষেপসহ নির্বাচন কমিশন থেকে ফল পরিবর্তনের ঘটনাও ঘটে। এতে ফলাফল যা হওয়ার তাই হলো।
এরশাদের জাতীয় পার্টিই বিজয়ী হলো। আওয়ামী লীগ এককভাবে ৭৬টি আসন পেয়ে দ্বিতীয় স্থান দখল করে। আগেই বলেছি, আমার মনে হয়েছে নির্বাচনটি ছিল স্বৈরাচারের ছকে আঁটা। যেদিন আওয়ামী জোট ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধুর বাসভবন থেকে নির্বাচন করার ঘোষণা দেয় সেদিন রাতে একই সময়ে বিএনপির তৎকালীন সদস্য ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার ধানমন্ডির ৫ নম্বর সড়কের বাসভবনে বেগম খালেদা জিয়া বিএনপি ও ৭ দলীয় জোট নেতৃবৃন্দের সাথে নির্বাচনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে বৈঠকে বসেন। আমি সেই সময় নাজমুল হুদার বাড়িতে উপস্থিত ছিলাম। নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে বেগম জিয়াকেও প্রথমে ইতিবাচক দেখেছিলাম। বেগম জিয়া আসার পর বিএনপির তৎকালীন স্থায়ী কমিটির সদস্য আব্দুল মতিন চৌধুরী ও ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা তার সাথে কথা বলে বাইরে কারো সাথে যোগাযোগ করতে গেলেন। এরই মধ্যে খবর এলো সাংবাদিক সম্মেলন করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট নির্বাচনের অংশগ্রহণের ঘোষণা দিয়েছে। তখন বেগম জিয়ার সাথে ধানমন্ডির ঐ বাসায় বিএনপির মাঝারি পর্যায়ের কয়েকজন নেতা ছিলেন। আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত শুনে তারা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন এবং বেগম জিয়াকে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ না করার জন্য চাপ দেন। প্রয়াত সিনিয়র সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরীসহ আমরা বেশ কয়েকজন সাংবাদিক সেখানে উপস্থিত ছিলাম। অনেকক্ষণ অবস্থানের পরও আমরা কোন সিদ্ধান্ত পেলাম না। মতিন চৌধুরী ও নাজমুল হুদাও ফিরে এলেন না। আমরা রাতে অফিসে এসে শুনি বিএনপি জোট নির্বাচনে যাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। বেগম জিয়ার কাছ থেকে তখন আমরা এ ব্যাপারে কিছু শুনিনি। পরে জেনেছি মতিন চৌধুরী, নাজমুল হুদাসহ কয়েকজন বিএনপি নেতার সাথে আওয়ামী জোট থেকে বেরিয়ে আসা জাসদ এবং ওয়ার্কার্স পার্টির নেতৃবৃন্দের কোন এক স্থানে বৈঠক হয়েছিল, সেখান থেকে নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ঘোষণাটি আসে।
এ নির্বাচন দুই জোটের দূরত্ব যোজন যোজন বাড়িয়ে দেয়। বিএনপি জোট আওয়ামী জোটকে ‘সুবিধাভোগী’ ইত্যাদি বলে আখ্যায়িত করে। আর আওয়ামী জোটও একইভাবে বিএনপি জোটকে ‘এরশাদকে ক্ষমতায় রাখার জন্য’ নির্বাচনে অংশ নেয়নি বলে প্রচারণা চালায়। বিএনপির তখন এরশাদের চাইতে বেশি ক্ষোভ ছিল আওয়ামী লীগের ওপর। নির্বাচনে অংশ নিলেও আওয়ামী লীগ সংসদ অধিবেশনে যোগ দেয় বেশ কিছুদিন পর। এরই মধ্যে এরশাদ সেনাপ্রধান থেকে পদত্যাগ করে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন দেন। আওয়ামী ও বিএনপি জোট রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ না নিয়ে ভোটের দিন হরতালের ঘোষণা দিলে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে গৃহ অন্তরীণ করা হয়। এরই মধ্যে এরশাদ প্রেসিডেন্ট বনে যান। আবারও এরশাদবিরোধী আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। যার যার অবস্থান থেকে কর্মসূচি পালন শুরু হয়। আগের মত যুগপৎ কর্মসূচি ছিল না। দুই জোটের লিয়াজোঁ কমিটিও ছিল না। এতে আন্দোলন তেমন গতি পাচ্ছিল না। আগেই বলেছি, আওয়ামী জোট এরশাদের অধীনে সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ায় বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ক্ষুব্ধ ছিলেন। এরশাদবিরোধী ঐক্যবদ্ধ বা যুগপৎ আন্দোলনের জন্য সুশীল সমাজসহ বিভিন্ন মহলের আবেদনে তিনি সাড়া দেননি। দূরত্ব বাড়তেই থাকে। এরই মধ্যে ১৯৮৭ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরের বন্যা দেখা দেয়। সারা দেশের মতো ঢাকাশহরও বন্যা কবলিত হয়ে পড়ে। অপ্রতুল ত্রাণ আর মানুষের দুর্ভোগের কারণে জনমত এরশাদে সরকারের বিরুদ্ধে চলে যায়। দেশে সচেতন সব মানুষই চান দুই জোটের ঐক্য। যুগপৎ আন্দোলন। এমনি এক সময়ে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ত্রাণ বিতরণের কর্মসূচি ছিলো পুরানো ঢাকার ধূপখোলা মাঠে। আমি তখন দৈনিক খবর-এ কাজ করি। দেশের প্রথম ফটোকম্পোজে ছাপা পত্রিকা।
দৈনিক খবর তখন বেশ জনপ্রিয়। আমি সেই সময় রাজনীতি, প্রশাসন, সংসদ এবং নির্বাচনসংক্রান্ত নিউজ বেশি করতাম। আমি চিন্তা করলাম এই সময়ে বেগম খালেদা জিয়ার একটি সাক্ষাতকার নিতে পারলে বেশ ভাল হয়। বিশেষ করে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন এবং বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে তার বক্তব্য নিতে পারলে খুব পাঠকপ্রিয় হবে। ত্রাণ বিতরণের কর্মসূচির কথা আগের দিনই বিনএপি অফিস থেকে আমাকে জানানো হয়। সাক্ষাতকারের চিন্তা মাথায় আসার পর রাতেই আমি ফোন করি রেজাবুদৌলা চৌধুরীকে। আগে তো মোবাইল ছিল না। নেতাদের সাথে কথা বলতে হতো গভীর রাতে। কর্মসূচি সেরে বা অফিস থেকে যখন বাসায় ফিরতেন। গভীর রাতে। তাই নিউজের জন্য হোক আর যোগাযোগের জন্য সে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। দলীয় অফিসে দেখা-সাক্ষাত হলেও বেশি কথা বলা বা নিউজ নেয়া সম্ভব হত না। নেতা-কর্মীরা থাকত, সাংবাদিকরা থাকত। রেজাবুদৌলা চৌধুরী তখন জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক দলের (জাসাস) সভাপতি। সদালপী, বিনয়ী, তখনকার সময়ে বিএনপির একনিষ্ঠ নেতা-কর্মী। বেগম জিয়ার সব কর্মসূচিতে থাকতেন, ঘনিষ্ঠও ছিলেন, টেলিফোনে আমি জানাতে চাইলাম, তিনি কাল ধূপখোলা মাঠে যাবেন কিনা। জানালেন যাবেন। আমি বললাম বেগম সাহেবের সঙ্গে আমার কয়েক মিনিট একান্তে কথা বলার সুযোগ দিতে হবে। আমি একটি বিশেষ নিউজ করব। তিনি বললেন, ত্রাণ বিতরণ সভায় এমন সময় দেয়া সম্ভব হবে কিনা এখনই বলা যাচ্ছে না। আর সেখানে অন্যান্য পত্রিকার সাংবাদিকও থাকবে তাই সুযোগ পাওয়া কঠিন হতে পারে। তার সঙ্গে আমার বেশ ভাল সম্পর্ক ছিল। আলাপ-আলোচনার একপর্যায়ে আমি প্রস্তাব দিলাম। ত্রাণ বিতরণ শেষে ফিরে আসার সময় গাড়িতে আসতে আসতে কথা বলা যেতে পারে। তিনি বললেন, তিনি ধোলাইখাল যাওয়ার আগে বেগম সাহেবের সঙ্গে কথা বলবেন। বেগম সাহেব রাজি হলে সেভাবে ব্যবস্থা নেবেন।
চলবে...
বইটি পড়তে হলে সপ্তাহের রবি, মঙ্গল, বৃহস্পতিবার চোখ রাখুন ‘বাংলাদেশ জার্নাল’ অনলাইনে।
বইটি প্রকাশ করেছে উৎস প্রকাশন
আজিজ সুপার মার্কেট (তৃতীয় তলা), ঢাকা।
বইটি সংগ্রহ করতে চাইলে ক্লিক করুন
আরএ
from BD-JOURNAL https://www.bd-journal.com/other/106186/রিপোর্টার-থেকে-সম্পাদক-(পর্ব--৩৪)